কুষ্টিয়ার চরপাড়া গ্রামে আধিপত্য বিস্তারে হত্যা, হামলা, মামলা, সংঘর্ষ ও গ্রেফতারের ভয়ে। কুমারখালীর সদকী ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রাম এখন মানুষ শূণ্য থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
আতঙ্কে পালিয়ে গেছে একমাত্র জামে মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেম। ভাঙা ঘরবাড়ি ও অবশিষ্ট মালামালের পাহাড়া দিচ্ছেন পুলিশ।
জানা গেছে, সময় সুযোগ পেলে প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আযান দেন পাশের গ্রাম গোপালপুরের মাজু খাঁ সরদার (৭০)। কখনও তিনি একাই নামাজ আদায় করেন। কখনও বা গ্রামে থাকা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে করে তিনি নামাজ আদায় করেন।
আর শুক্রবারে বাইরে থেকে হুজুর ডেকে এনে জুমআ’র নামাজ অনুষ্ঠিত হয় মসজিদটিতে। দুপুর একটার দিকে চরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মোড়ে পুলিশ রয়েছে। গ্রামের বাসিন্দারা কেউ নেই।
প্রায় সকল বাড়িতেই ভাংচুরের ক্ষত রয়েছে। নেই গৃহপালিত পশুপাখি ও অন্যান্য মালামাল। কয়েকটি ভাঙা বাড়িতে পড়ে আছে পবিত্র কুরআন শরীফ।
আরো দেখা যায়, বেলা ১ টা ১৫ মিনিটের সময় যোহরের আযান দিলেন একজন বৃদ্ধ। আযান শেষে বৃদ্ধের সাথে কথা বলে জানা গেল তাঁর নাম মাজু খাঁ সরদার (৭০)। তিনি পাশের গ্রাম গোপালপুরের বাসিন্দা।
আযানের কিছু সময় পরেই তিনজন পুলিশ সদস্য মসজিদে প্রবেশ করলেন। চারজন মুসল্লি নিয়ে জামাতের ইমামতি করেন একজন পুলিশ সদস্য।
এবিষয়ে বৃদ্ধ মাজু খাঁ সরদার বলেন, এক তারিখের মার্ডারের (হত্যা) পর একপক্ষ পালিয়েছে। প্রাণভয়ে মসজিদের ইমাম – মুয়াজ্জেমও চলে গেছে। কেউ মসজিদে আসেনা। সময় সুযোগ পেলে আমি এসে আযান দিই। কখনও একাই নামাজ পড়ি। কখনও পুলিশের সাথে নামাজ পড়ি।
তিনি আরো বলেন গত শনিবারের ঘটনায় পুরো গ্রামের লোক পালিয়ে গেছে। আজ যোহরের নামাজে একজন পুলিশ সদস্য নামাজের ইমামতি করেছেন। গত শুক্রবার বাইরে থেকে হুজুর ডেকে এনে জুমআ’র নামাজ পড়েছিলাম। তবে মসজিদ ও নামাজের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি নামাজ পড়ানো ওই পুলিশ সদস্য।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগে চরপাড়া গ্রামে বসবাস শুরু করেছিলেন তাঁরা। তখন কোনো গ্রুপিং, আধিপত্য ছিলোনা। বর্তমানে গ্রামটিতে প্রায় শতাধিক পরিবার বসবাস করেন। সেখানে ভোটার সংখ্যা প্রায় তিন ‘শ।
হঠাৎ ২০২০ সালে গ্রামের শাজাহান আলীর জমির আইল নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর এলাকায় তৈরি হয় গ্রুপিং। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন গ্রামের দুলাল মিস্ত্রি। অপর গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় সাবেক মেম্বর আনসার আলী।
থানা-পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৬ মে জমি সংক্রমান্ত জেরে দুলাল মিস্ত্রির সমর্থক হুমায়ন মন্ডল (৪৪) কে কুপিয়ে হত্যা করেছিল প্রতিপক্ষরা । নিহতের ছোট ভাই সাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে ৩৬ জনের নামের একটি মামলা দায়ের করেছিল। মামলা নম্বর ৯।
এরপর গত সোমবার (১ আগষ্ট) হুমায়ন হত্যা মামলার ৪ নং আসামী ও আনসার আলী মেম্বরের সমর্থক সেলিমকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষরা। এঘটনায়ও নিহত ভাই শাহীন আলী থানায় ২৯ জনকে আসামী করে মামলা করে। মামলা নম্বর ২।
উক্ত মামলায় হামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে আসামীপক্ষরা পলাতক ছিলেন। এরপর সেলিম হত্যা মামলার আসামীরা জামিন নিয়ে প্রায় দুই শতাধিক সমর্থক নিয়ে গত শনিবার সকালে গ্রামে প্রবেশ করে এবং বাড়িতে ওঠে।
এনিয়ে উভয়পক্ষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুনরায় সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত চারজন গুরুতর আহত হন। আহতরা হলেন গ্রামের মৃত শামছুদ্দিন শেখের ছেলে লিটন শেখ (২৫), মুহাম্মদের ছেলে মামুন আলী (৩৫), আহম্মদ আলীর ছেলে আসলাম (৪৫), মৃত ফয়েজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাশেম (৫০)। তাঁরা কুষ্টিয়া সদরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তবে এঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। এবিষয়ে আনসার আলী মেম্বর মুঠোফোনে বলেন, প্রতিপক্ষরা জামিন নিয়ে গ্রামে ঢুকে নতুন করে হামলা চালিয়েছে। আমার তিনজন গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। মামলা করা হবে।
হামলা ও মামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন দুলাল মিস্ত্রি ও তাঁর সমর্থকরা। তবে জানতে চাইলে তাঁর একজন সমর্থক আশরাফুল ইসলাম ফেসবুকের কমেন্টে জানিয়েছেন, গত শনিবার জামিনে তাঁরা গ্রামে যান। এসময় প্রতিপক্ষরা তাঁদের উপর হামলা চালায়। কিন্তু আমরা আর সংঘর্ষ চাইনা। গ্রামে বাস করতে চাই।
সদকী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিনহাজুল আবেদীন দ্বীপ বলেন, আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ধ্বংসের পথে চরপাড়া। গ্রামটিতে স্থায়ী শান্তির জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কুমারখালী থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, আধিপত্য নিয়ে তাঁদের বিরোধ চলছে। গত শনিবার সেলিম হত্যা মামলার আসামীরা বাড়িতে ওঠে। এনিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এঘটনায় এখনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কোনো মামলা হয়নি।