বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও নীতি প্রণয়নে তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কোম্পানীর হস্তক্ষেপের কারনে তামাক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকারের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে।
তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করলেও তামাক কোম্পানী গুলো সারাদেশে বিভিন্ন উপায়ে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা মূলক কর্মসূচীর আড়ালে নানা উপায়ে প্রচারণা অব্যহত রেখেছে। যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত রাষ্ট্রের আইনের চরম লংঘন। উল্লেখ্য ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন এর ৫ এর (৩) ধারায় সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে কোন তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী কোম্পানীর নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট কর্তৃক সংগৃহিত “তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ” সংক্রান্ত তথ্যে দেখা গেছে, নিরাপদ পানির প্লান্ট স্থাপন, সামাজিক বনায়ন, বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের বিষয়টি উদযাপন, কোভিড ভ্যাকসিন রেজিষ্ট্রেশনে সহায়তা, খেলা স্পন্সর, নারী দিবস, পানি দিবসসহ নানা দিবস ভিত্তিক কর্মসূচী পালন, প্রভৃতি কর্মকান্ডের মাধ্যমে তামাক কোম্পানী গুলো সর্বদা মিডিয়াতে থাকার প্রতিযোগীতায় মেতেছে। এসকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে তামাক সেবন করিয়ে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করা।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, তামাক কোম্পানী গুলোর নিত্য নতুন কৌশলের মাধ্যমে সরকারের সুদৃষ্টি পাওয়ার চেষ্টায় বিভিন্নভাবে সচেষ্ট। যার মধ্যে অন্যতম বিড়ি মালিকদের সরকারের পক্ষে ভোট চাওয়া, দোয়া মাহফিল আয়োজন ইত্যাদি। তামাক কোম্পানী গুলোর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও কর বৃদ্ধির প্রাক্কালে তামাকের উপর কর না বাড়ানোর দাবীতে সমাবেশ, মানববন্ধন, মহাসমাবেশ আয়োজন চলমান ছিলো। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো এবং গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার। ইদানিং বেসরকারী সংস্থাগুলোকে ফ্রন্ট গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাথে থেকে অনুষ্ঠান আয়োজনের চেষ্টা করছে তামাক কোম্পানিগুলো।
মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও বিগত কয়েক বছরে নতুন নতুন তামাক কারখানা স্থাপন এবং তামাক কোম্পানীকে বিনিয়োগ বোর্ড এর মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা প্রদাণ সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অতি সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপের আরো কিছু নজির উঠে এসেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য “নাটক সিনেমায় ধূমপানে দৃশ্য দেখানোর দাবী”, “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা” স্থগিত করনের প্রচেষ্টা।
সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রচেষ্টায়ও নানা ভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করার চেষ্টা অব্যহত রেখেছে কোম্পানীগুলো। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে অংশীজনদের মতামত গ্রহণ করা হচ্ছেনা বলে তামাক ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছে। অথচ ১৪ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত সকলের মতামত গ্রহণের জন্য সরকার জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এর ওয়েব সাইটে আইনটি প্রদান করেছিলো। এর পূর্ববর্তী সময়েও দেশে আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে অর্জনকে ধরে রাখতে হলে সহায়ক নীতিগুলো সুরক্ষায় অর্থাৎ তামাক কোম্পানীর প্রভাব মুক্ত রাখায় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ক্ষতিকর তামাক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানী থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। যার বহু প্রকৃত উদাহরন আমাদের দেশেও রয়েছে। অল্প কিছুদিন পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যয় অনুসারে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার রাষ্ট্রপতি শিল্প উন্নয়ন পুরুষ্কার থেকে তামাক কোম্পানীকে মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টি বাদ দিয়েছে। প্রণয়ন করা হচ্ছে তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতি। যা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং প্রশংসার দাবীদার।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তামাক নিয়ন্ত্রণকে আরো অধিক গুরুত্ব প্রদান এবং কো¤পানিগুলোকে যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। সুতরাং এক্ষেত্রে এফসিটিসি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নৈতিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিশে^রবিভিন্ন দেশ রাষ্ট্রিয়আইনবা কোড অব কন্ডাক্টেরমাধ্যমে তামাকনিয়ন্ত্রণে আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়নের উদ্যোগগ্রহণকরছে।
তামাকনিয়ন্ত্রণে কাঙ্খিত লক্ষমাত্রা অর্জনে অতি দ্রুত তামাক কোম্পানী থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহারের পাশাপাশি নি¤েœাক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে সুপারিশসমুহ- (১) ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিক্যাল ৫.৩ এর সুপারিশ সমুহ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ। (২) সকল সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীর জন্য তামাক কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ বিষয়ে আচরন বিধি প্রণয়ন।(৩) রাষ্ট্রে প্রচলিত যে সকল আইন তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এগুলো প্রয়োজন অনুসারে সংশোধন ও যুগোপযোগী করা।(৪) তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নএবং সংশোধনের মাধ্যমে শক্তিশালীকরণ।(৫) পাঠ্যপুস্তকে তামাকে অর্থকরী ফসলের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। (৬) তামাক কর ব্যবস্থা আধুনিকায়ন এবং তামাক কর নীতি প্রণয়ন।(৭) সকল ধরনের রাষ্ট্রিয় পুরষ্কার থেকে তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম বাদ দেওয়া।(৮) সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষণ কাজে সম্পৃক্ত করা।