• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১:২৬ পূর্বাহ্ন

৬ ডিসেম্বর; পাকিস্তানি সেনা ছেড়েছে মেহেরপুর

বিবর্তন ডেস্ক
Update : মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২
৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা ছেড়েছে মেহেরপুর
৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা ছেড়েছে মেহেরপুর

আজ ৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার সুতিকাগার মুজিবনগর খ্যাত মেহেরপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী মেহেরপুর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ৫ ডিসেম্বর গভীর রাত থেকে হানাদার বাহিনী গোপনে মেহেরপুর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। পাকিস্থানীদের শক্তিশালী সামরিক বলয় একে একে ভেঙ্গে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায়। ৬ ডিসেম্বর ভোরে মিত্র বাহিনী মেহেরপুরে প্রবেশ করলে অবরুদ্ধ জনতা মিত্র বাহিনীর সাথে মেহেরপুর বিজয়ের উল্লাস করে।
জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার সুতিকাগার মুজিবনগর তথা মেহেরপুরের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধকালীন সময়ে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহির সক্রিয় ভূমিকায় ছাত্র-জনতা, আনসার-মুজাহিদদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়।
তথ্যমতে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারে শপথ গ্রহণের পর পরই মেহেরপুুর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। সে অনুযায়ী ১৮ এপ্রিল দুপুরেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে বারাদি হয়ে সড়ক পথে মেহেরপুর প্রবেশ করার সময় সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালালে এ অঞ্চলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে এ জেলার সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারতের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে প্রতিরোধ যুদ্ধে অভিজ্ঞ ছাত্র-শিক্ষক আনসার-মুজাহিদরাও। ভারতের হৃদয়পুর, শিকারপুর, বেতাই, কাচুলিয়া , করিমপুর, বিহারসহ বেশ কয়েটি জায়গায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ভারতীয় বাহিনীর তত্বাবধানে বাংলাদেশী যুব সমাজ গেরিলা ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে। প্রথম অবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমান অস্ত্র না পাওয়ায় তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়লেও দেশ স্বাধীনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকেই গোপনে দেশে এসে বিভিন্ন ক্যাম্প লুট করে সে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।
১৮ এপ্রিল পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী মেহেরপুরে আসে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে মেহেরপুর সরকারী কলেজ, ভিটিআই এবং কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলসহ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের শক্তিশালী দূর্গ গড়ে তোলে। এছাড়াও মেহেরপুরের সীমান্ত গ্রাম মহাজনপুরের পাশে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদা হাইস্কুলে পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। এ ঘাঁটির সাথে নুরপুর, মানিকনগর ও মেহেরপুর ক্যাম্পের সার্বক্ষনিক যোগাযোগ হত। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে গোটা মেহেরপুর জেলা পাকবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়। জুন-জুলাই মাসের দিকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলারা মেহেরপুরে ফিরে সেতু কার্লভাট ধ্বংস এবং টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করে মাইন পুতে রেখে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ এবং খাদ্য সরবরাহে সংকুল করে তোলে। আগষ্ট মাসের ২ ও ৩ তারিখে মানিকনগর ক্যাম্প উঠিয়ে মোনাখালিতে এবং কাথুলি ক্যাম্প উঠিয়ে গাংনীর ভাটপাড়া নীলকুঠিতে ক্যাম্প স্থাপন করতে বাধ্য হয়।
দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস ধরে পাকসেনারা পিচ কমিটি ও রাজাকারদের সহায়তায় সাধারণ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালাতে থাকে। পাকিস্থানী সৈন্যবাহিনী আমঝুপি, গোভীপুর, বুড়িপোতা, কোলা, পিরোজপুর, শলিকা, রাজাপুর, জোড়পুকুরিয়া, বাগোয়ান-রতনপুর, ভাটপাড়া কুঠি, সাহেবনগর, হিন্দা, ওয়াপদা মোড়, কাজিপুর, তেরাইল ও বাড়িবাঁকাসহ বিভিন্ন গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। যেখানেই গণহত্যা সেখানেই বধ্যভূমি রয়েছে। তার মধ্যে মেহেরপুর কলেজের উত্তরে বিস্তৃত খোলা মাঠ, কালাচাঁদপুর ঘাট ও ভাটপাড়া টেপুখালীর মাঠ অন্যতম বধ্যভূমি।
তিন মাসে খলিশাকুন্ডি, কাজিপুর, গোয়ালগ্রাম ও সাহেবনগরসহ, অন্তঃত ৫৫ টি স্থানে পাকিস্থানী হানদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। ১৩ জুন গাংনী থানার তৎকালিন ওসি আব্দুস সাত্তার ৭ সদস্যের পুলিশ দল নিয়ে ছাতিয়ান এলাকায় টহল দেওয়ার সময় ওই গ্রামের রইছ কামার দলবল নিয়ে তাদের উপর হামলা চালিয়ে ৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে বেশ কয়েকটি অস্ত্র¿ লুট করে শিকারপুর অ্যাকশান ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। এমনই ভাবে অসংখ্য জায়গাতে মুক্তিকামী বাঙালিরা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে থাকে। কয়েকটি স্থানে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ১শ’ ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও কোনঠাসা হয়ে পড়ে পাকবাহিনী।
১৯৭১ এর ৩ ডিসেম্বর রাতে মেহেরপুর শহর চারপাশ থেকে মু্িক্তযোদ্ধারা ঘিরে হানাবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে একই সময়ে হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ৫ ডিসেম্বর কড়–ইগাছি, রাইপুর, কুঞ্জনগর, শিমুলতলা, সহড়াবাড়িয়া, ঝোড়পাড়াসহ বেশ কিছু গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা রওনা হয়ে গোপালনগরে একত্রিত হয়। এরই মধ্যে ভারত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ঘোষনা করলে এক দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল হয়ে ওঠে আকাশচুম্বি, অন্যদিকে পাকিস্থানী বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায় ও পলায়ন প্রবন হয়ে ওঠে। শিকারপুর অ্যাকশন ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধার দল কাজিপুর-সাহেবনগর হয়ে বামুন্দি পাকসেনা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে একযোগে আক্রমন করে। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমনে পিছু হটে কুষ্টিয়া রওনা হওয়ার পথে শুকুরকান্দির নিকট মুক্তিযোদ্ধা তাহাজের নেতৃত্বে একটি দল তাদের উপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমন করলে বেশ ক’জন পাকসেনা নিহত হয়। ৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার জৈল সিংয়ের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর বিশাল বহর মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করে। তার পুর্বেই পাকবাহিনীরা লেজ গুটিয়ে চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া হয়ে পালিয়ে যায়। মেহেরপুর হানাদার মুক্ত হয়। সেই দিনের স্মরণে মেহেরপুর সরকারী কলেজ মোড়ে স্থাপিত হয় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছর এই দিনে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জালীর মধ্যদিয়ে এ দিবসটি পালন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাক্ষদর্শি মেহেরপুরের আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষদের ধরে নিয়ে শহরের ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে ও সরকারি কলেজের পিছনে ও তাহের ক্লিনিক পাড়াসহ বিভিন্ন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালাতো। ৫ ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদার বাহিনী চলে যাবার সময় মেহেরপুরের ওয়াপদা, সদর উপজেলার চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দ্বীনদত্ত ব্রীজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন বলেন, আমরা ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনীকে বিতাড়িত করতে ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুরের বারাদী বাজারে আক্রমন করি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুূখে পার্শ্ববর্তী দরবেশপুর দিয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে পালিয়ে যায় শত্রুরা। ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হয়। আমরা বিজয়ী হুংকার দিয়ে মেহেরপুরে প্রবেশ করি। আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনন্দ করি। কিন্তু অসংখ্য বধ্যভূমি আর লাশ দেখে মেহেরপুরে প্রবেশ করার পর আমাদের সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। তারপরও স্বাধীনতার সেই অপার আনন্দ অতুলনীয় এখনও সেই মুর্হুতটা চোখে ভাসে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category