• বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৬ অপরাহ্ন

কুষ্টিয়ায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড বিচারক তাজুল ইসলামের

ইসমাইল হোসেন, কুষ্টিয়া / ১৩৪ Time View
Update : বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২
কুষ্টিয়ায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড বিচারক তাজুল ইসলামের
কুষ্টিয়ায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড বিচারক তাজুল ইসলামের

কুষ্টিয়ার আদালত পাড়ায় ব্যাপক জনপ্রিয় বিচারক তাজুল ইসলাম ১৫ বছরের বিচারক জীবনে তিনি যে আদালতে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড গড়েছেন। কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মো. তাজুল ইসলাম ১ বছর ৪ মাসে আট শতাধিক মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড করেছেন। যা বিচার বিভাগে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে।

দেশের সিংহভাগ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা জট রয়েছে। তবে নিজের মেধা, বিচক্ষণতা, দক্ষতা, আন্তরিক মানসিকতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিচারক তাজুল ইসলামের এ কার্যক্রম ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটা অন্য বিচারকরা অনুসরণ করলে বিচার বিভাগ থেকে মামলার জট নিরসন হবে। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মামলাজট নিরসনে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন তিনি। তার কর্মদক্ষতা ও নিরলস পরিশ্রমের কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিক সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়ছে সাধারণ মানুষের। জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম কিছুটা থমকে গিয়েছিল। সেই সময়ে ২০২১ সালের ২৭ জুন বিচারক মো. তাজুল ইসলাম কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক হিসেবে যোগদান করেন।

বিচারক মো. তাজুল ইসলাম প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক পুরোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। দায়িত্ব নেওয়ার পর ৮০০টির অধিক মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। তার মধ্যে হত্যা মামলা ৬৪টি, অস্ত্র ও ডাকাতি মামলা শতাধিক, ফৌজদারি আপিল ৩০০টির অধিক, দেওয়ানি আপিল ৩০০টি এবং শতাধিক রিভিশন মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। যেগুলো ১০ বছর বা ১৫ বছরের অধিক পুরোনো মামলা। তিনি পুরোনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তি করেছেন। এ সময় তাকে প্রায় এক হাজার এক শতাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে হয়েছে।

বিচারক তাজুল ইসলাম ইতোপূর্বে খুলনা, ঢাকা, মেহেরপুর, ঠাকুরগাঁও ও ঝিনাইদহ আদালতে বিচারক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলা জট নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৮ সালের ২২ মে খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সহকারী জজ হিসেবে তিন বছর ছিলেন। এক বছর এক মাস পারিবারিক আদালতে ছিলেন। সেখানে সাড়ে তিন হাজার মামলা ছিল। এক বছর এক মাসে ১৮০০ মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড করেছিলেন। তারপর ঢাকা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চার বছর ছিলেন। সেখানে প্রতি মাসে ৪০-৫০টি দুতরফা মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। সেখান থেকে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে এক বছর ৮ মাসে দেওয়ানি, মাদক, অস্ত্রসহ ১০০০ মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। এরপর মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে ২০১৭ এপ্রিল থেকে ২০১৮ নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সাড়ে ৩০০ মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে করোনাকালীন এক বছর ৯ মাসে ২২০০ মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।

 

এবিষয়ে বিচারক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এক বছর চার মাস আগে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কুষ্টিয়া আদালতে যোগদান করি। এখানে এসে প্রচুর পুরাতন মামলার জট দেখলাম। তারপর চিন্তা করলাম, বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ-দুর্দশা লাঘব করা দরকার এবং ঝুলে থাকা পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করা জরুরি। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি সফল হয়েছি। বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীরা ও সংশ্লিষ্ট সবাই খুশি হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, পুরো টিম ওয়ার্ক হিসেবে আমরা কাজ করছি। আইনের মধ্যে থেকে মামলা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছি। আমার আদালতে সাক্ষী এলে ফেরত যায় না। আদালতের সময় শেষ হলেও সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে তাকে বিদায় দেওয়া হয়। এতে করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। সাক্ষী ফেরত দিলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এজলাস সময়ের বাইরেও বিচারিক কাজ থাকলে সেটা করি। দিনের কাজ দিনে শেষ করার চেষ্টা করি। একজন বিচারকের ন্যায় বিচারে সবাই খুশি হয়। বিচারকাজে রাষ্ট্রপক্ষ, আইনজীবী, পুলিশ, সহায়ক কর্মচারী, প্রসিকিউশন সাইড সবার সহযোগিতা থাকলে আগামীতেও প্রচুর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। কুষ্টিয়ার জনগণ যাতে সঠিক বিচার পান এবং বিচারপ্রার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়, সে ব্যাপারে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা ২০০ বছর ধরে চলছে। এটা একটা বিধিবদ্ধ আইন। নিয়মের মধ্যে থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তিনি বলেন, যেদিন বেশি মামলার রায় হয় অথবা অফিসের অন্যকোনো জরুরি কাজ থাকে, সেদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করে থাকি। আমি আন্তরিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করি। ফলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। সময়মতো অফিস করলে এবং সময়ের কাজ সময়ে করলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আন্তরিকতা ও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কোনো ধরনের ফাঁকি দেওয়ার মন-মানসিকতা থাকলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব না। বিচারক তাজুল ইসলাম বলেন, মামলার উভয় পক্ষের মানুষের সহযোগিতায় ন্যায় বিচার করা, হত্যা মামলাসহ সব ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সত্যিই আনন্দদায়ক। আমি আমার ১৫ বছরের চাকরির জীবনে সব সময় কর্মস্থলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি। আমি সফল হয়েছি, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়েছি। কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সহযোগিতায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। এজন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

তিনি বলেন, এত মামলা নিষ্পত্তির পেছনে আমাদের একটা টিমওয়ার্ক কাজ করে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় আমি টিমওয়ার্ক হিসেবে চালিয়ে নিচ্ছি। মামলা নিষ্পত্তি করে আমি প্রত্যেকটা মামলার দিন তারিখ বাদী, আসামি, আইনজীবীদের সামনে দিয়ে থাকি। তাছাড়া আমি কোর্টে বসে থেকে প্রত্যেক দিন বিকেলে মামলার কজ লিস্ট ডিজিটাল ড্যাশবোর্ডে দিয়ে থাকি। এতে ঘরে বসে অনলাইনে সন্ধ্যার আগেই মামলার দিন তারিখ সহজেই মামলার স্ট্রোকহোল্ডার পেয়ে যাচ্ছে। কি ফলাফল হচ্ছে সেটাও পেয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ। বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘবে ডিজিটাল কজ লিস্ট অনলাইনে দেওয়ার সিস্টেম অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। এতে মানুষের ঘাটেঘাটে পয়সা দেওয়া কমবে। তিনি বলেন, আমি অফিস টাইমের পরও রায় লেখার কাজ করি। অফিস টাইমে এজলাস করে রায় লিখি। আমি চেষ্টা করি প্রত্যেকটা আদেশ লিখে নিয়ে তারপর ঘোষণা করা। তাতে আসামির খালাস বা শাস্তি কেন হলো সেই ব্যাপারটা জানতে পারে। সঠিক সময়ে নকল নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারে। অফিস টাইমের পরেও অফিসের কাজ করি। পাশাপাশি পেনডাইভে করে বাসায় গিয়েও অফিসের কাজ করি। আর আমার আদালতে কোনো কাজ বাকি থাকে না। তিনি বলেন, আমি যখন কুষ্টিয়া আদালতে যোগদান করি, তখন ৭ শত’র অধিক মামলা পেয়েছিলাম। জেলা ও দায়রা জজ মহোদয় যে মামলাগুলো বিচারের জন্য পাঠান, সেগুলোই মূলত আমরা বিচার করে থাকি। ২০, ২৫, ১০ বা তারও বেশি বছরের পুরাতন অনেক মামলা ছিল। আমি আসার পর ১২৪টি পুরাতন মামলা পেয়েছিলাম। তার মধ্যে শতাধিক মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ৭-৮টি মামলা নিষ্পত্তি হতে বাকি আছে। সেগুলোও চুড়ান্ত নিষ্পত্তি, যুক্তিতর্ক এবং রায়ের পর্যায়ে রয়েছে। আমি কুষ্টিয়ায় দায়িত্ব নেওয়ার পর ৮০০টির অধিক মামলা নিষ্পত্তি করেছি। যেগুলো ১০বা ১৫ বছরের অধিক পুরোনো মামলা। আমি পুরোনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করি। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থায় যে নিয়ম রয়েছে, সেই নিয়ম ফলো করি। সাধারণ জনগণ যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ন্যায় বিচার পাওয়া সকলের সাংবিধানিক অধিকার। আমাদের রাষ্ট্র বেতন দেয় জনগণের সেবার জন্য, তাদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য। এটা আমাদের শুধু সাংবিধানিক দায়িত্ব নয় বরং নৈতিক দায়িত্ব। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কুষ্টিয়া আদালতে আমি যোগদান করেছিলাম ২০২১ সালের ২৭ জুন। তখন করোনার সময়। কোট বন্ধ ছিল। দুই মাস অনলাইনে ভার্চুয়াল কোর্ট চলেছিল। ফলে সেসময় মামলা নিষ্পত্তি কম হয়েছিল। পরে বিধি-নিষেধ কেটে গেলে স্ব শরীরে আদালত চালু হলে বিচারপ্রার্থী জনগণের দুঃখ-দুর্দশা-হয়রানি লাঘবে আমাদের যা যা করণীয় তার সর্বোচ্চটুকু করার চেষ্টা করেছি। প্রতি মাসে ৫০-৬০টি মামলা নিষ্পত্তি করেছি। ৬৪টি হত্যা মামলা নিষ্পত্তি করেছি। সারা দেশে হত্যা মামলা নিষ্পত্তিতে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
error: Content is protected !!