• শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩, ১০:১৫ পূর্বাহ্ন

সৃষ্টি রহস্য খুঁজতে সাধুর সঙ্গে ঘর বেঁধেছে ফ্রান্সের দেবোরা

ইসমাইল হোসেন, কুষ্টিয়া / ১১৮ Time View
Update : রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২২
সৃষ্টি রহস্য খুঁজতে সাধুর সঙ্গে ঘর বেঁধেছে ফ্রান্সের দেবোরা
সৃষ্টি রহস্য খুঁজতে সাধুর সঙ্গে ঘর বেঁধেছে ফ্রান্সের দেবোরা

মরমি সাধক ফকির লালন শাহকে নিয়ে গবেষণার জন্য সুদূর ফ্রান্স থেকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আসেন দেবোরা । সাধুসঙ্গে এসে লালন দর্শনের প্রেমে পড়ে যান এই তরুণী। তারপর আর দেশে ফেরা হয়নি দেবোরার। বর্তমানে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বসবাস করেছেন তিনি। মাঝে মাঝে ফ্রান্সে ঘুরতে যান। নাম বদল করে হয়েছেন দেবোরা জান্নাত।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম গবেষণার কাজে ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে আসেন দেবোরা । এরপর বাউল নহির শাহের শিষ্য হন তিনি। অবিবাহিত দেবোরা গুরুর আস্তানায় বসবাসকারী নহির শাহের আরেক শিষ্য রাজনকে বিয়ে করেন। নাম রাখা হয় দেবোরা জান্নাত। এখনো গুরুর কাছে আত্মিক শান্তি ও সৃষ্টি রহস্য খুঁজতে দীক্ষা নিচ্ছেন। ফকির লালন শাহকে যতই জেনেছেন ততই তার প্রেমে পড়েছেন তিনি। বেড়েছে শ্রদ্ধাভক্তি ও প্রেমবোধ। দেবোরা জান্নাত প্যারিসের মেয়ে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। মা চিকিৎসক এবং বাবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দেবোরা গুরু নহির শাহ বাংলাদেশের একজন প্রবীণ লালন ভক্ত সাধক। গুরু নহির শাহের ভাতিজা ও শিষ্য রাজন ফকিরের সাথেই দেবোরাহ বিয়ে হয়েছে। হেম আশ্রমের পাশে দীঘির পাড়ে বাড়ি করেছেন তারা। সেখানেই সুখে শান্তিতে বসবাস এই দম্পতির। নিজেদের ছোট্ট ঘরটি সাজিয়েছেন ফরাসি সংস্কৃতির আদলে। তাকে সাজানো রয়েছে সারি সারি বই। দেবোরাহ বলেন। আমি যখন গুরুর হেম আশ্রমে প্রথম প্রবেশ করি তখন গুরু স্বাগতম জানালেন। তিনি তারপাশে বসার জায়গা দিলেন। তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় মুগ্ধ হলাম। আমিও আমার গন্তব্য খুঁজে পেলাম। গুরুর সাথে ভালো একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছি। গুরু সমাজের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি শান্তি খুঁজে পেয়েছি লালন দর্শনে। তাই আর ফ্রান্সে ফিরে যাব না। লালনের দেশে গুরুজি নহির শাহ’র শিষ্য হিসেবে আমৃত্যু সাধুসঙ্গ নিয়ে থাকতে চাই। দেহ কেবলমাত্র সবকিছু বয় মরে গেলে লাশ মাত্র। আমি আমার মরদেহটি এই কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের প্রাগপুরের হেম আশ্রমে রেখে দিতে বলব মাজার হবে এখানেই।

তিনি আরও বলেন, আমি বাংলাদেশে সাধুসঙ্গ দেখতে এসেছিলাম গবেষণার জন্য। কিন্তু শেষ বেলায় সিদ্ধান্ত নিতে হলো কোনটা আমার জন্য বেশি জরুরি। সামাজিক জীবন আর একটা সার্টিফিকেট অর্জন নাকি গুরুকে ধরে সত্যিকারে ভক্ত হওয়া। এ সময় সাধকের আধ্যাত্মিকতা দেখে লালন দর্শনের প্রেমে পড়ে যাই। দেবোরাহ জান্নাত বলেন, আমি বিশ্বের ৫৪টি দেশে গিয়েছি। সবচেয়ে বাংলাদেশকে ভালো লেগেছে। তারপর লালন দর্শনের আমার খুব ভালো লেগেছে। গুরু পেয়েছি, সাধু সমাজের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার গুরু খুবই জ্ঞানী একজন মানুষ। হেম আশ্রমকে আমার আপন ঠিকানা করে নিয়েছি। সংসার ও বিয়ের ব্যপারে দেবোরা জান্নাত বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই সাধনমুখী এবং গুরুবাদী মানুষ। তাছাড়া দুজনের মধ্যে ভালোবাসা আছে স্বপ্ন আছে। পরে গুরু আশীর্বাদে ও সাধু সমাজের আশীর্বাদে প্রয়োজনের তাগিদেই আমাদের বিয়েটা করা। বিয়ে না করে একা থাকা যায়। কিন্তু সেখানে অপূর্ণতা থেকে যায়। সাধনাকে পূর্ণ করার জন্য একজন সঙ্গী লাগে। এজন্য বিয়েটা করেছি। বেশ কয়েক বছরে কখনো স্বামীর সাথে অশোভন আচরণ হয়নি।

আমার স্বামী সাধু সমাজের সাথে অনেক আগে থেকে চলাফেরা করে আসছেন। তার সাথে আমার সবকিছু মিলে যায়। একসাথে চলতে কোনো সমস্যা হয় না। আমাদের সম্পর্কটা অনেক গভীর, মজবুত এবং স্থির। দুজনে একই তাল, লয় ও সুরে চলি। সবকিছু মিলে আমরা সুখে-শান্তিতে আছি। বাকিটা জীবন একই পথে একসাথে দুজন দুজনের হাত ধরে চলতে চাই। তার অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ।

তিনি বলেন, লালন শাহের সাধনার গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করে। বাস্তবের সাথে একটা জ্ঞান তৈরি করা যায়, সেটা লালনের দর্শনের মধ্যে পেয়েছি। মানুষের আচরণ-স্বভাবের আত্মসংস্কারের পথ কীভাবে তৈরি করা যায়। সেটা সুন্দর ও স্পষ্টভাবে বাস্তবের সাথে ভিত্তি করে লালন দর্শনে পেয়েছি। লালনের বাণী জানতে হলে বা সাধু সমাজের চলতে গেলে বাংলা ভাষা শিখতেই হবে। তাছাড়া সবার সাথে কথা বলার জন্য ভাষা শেখাটা শুরু করি। দুই সপ্তাহের মধ্যে নিজে নিজে বর্ণমালা শিখে ফেললাম। তারপর বাংলা ভাষা শেখার জন্য ক্লাস করলাম। তারপর চর্চা করে ছয় মাসের মধ্যে ভাষাটা শিখেছি। এখন বাংলা বলতে বা বুঝতে সমস্যা হয় না। শেখার পেছনে গুরু, স্বামী ও শিশুদের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেবোরাহ জান্নাতের গুরু নহির শাহ বলেন, জল শূণ্য মোহনা আর প্রেম শূণ্য হৃদয় সমান। তাই আমাদেরকে তার প্রেমিক হতে হবে। সুদূর ফ্রান্স থেকে দেবোরা জান্নাত যখন আমাদের মাঝে সাথে মিশলো, তখন সাধু গুরু মহলে ঢোকার পরে বুঝলো আমাদের মধ্যে অকৃত্রিম প্রেমবোধ আছে। যেখানে সবাই মানুষ সবাই সমান কোনো ভেদাভেদ নেই। দীর্ঘদিন আমাদের ব্যবহার চালচলন খাদ্যাভ্যাসসহ সবকিছু তার মন মতো হওয়ায় সে এদেশেই রয়ে গেছে। লালন দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করে। তারপর সে লালন দর্শনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। সে এখন লালনের দেখানো পথের অনুসারী। আমার আরেক শিষ্য রাজনের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। দেবোরা জান্নাতের স্বামী রাজন ফকির বলেন, আমি দেখতে একজন বিদেশী মানুষকে বিয়ে করেছি। কিন্তু তার আচার আচরণ কথাবার্তা চালচলন মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা কোনো কিছুই বিদেশীদের মতো নয়। সে বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষকে ভালোবাসে। এজন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
error: Content is protected !!