• শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩, ০৮:২৯ অপরাহ্ন

কুষ্টিয়ার স্কুল শিক্ষিকার হত্যাকারী ভাতিজা আটক

ইসমাইল হোসেন, কুষ্টিয়া / ২২৮ Time View
Update : মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০২২
কুষ্টিয়ার স্কুল শিক্ষিকার হত্যাকারী ভাতিজা আটক
কুষ্টিয়ার স্কুল শিক্ষিকার হত্যাকারী ভাতিজা আটক

নিজ সন্তানের মত আদর ভালবাসা দিয়ে ছোট বেলা থেকেই কোলে পিঠে করে মানুষ করা আপন ভাইয়ের ছেলের হাতেই খুন হতে হলো কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা রোকসানা খানম রুনা (৫২)। ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত (২০) একাই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় শীল দিয়ে মাথায় পরপর দুটি আঘাত করে ফুফু রুনাকে হত্যা করে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই রহস্য উন্মোচন ও হত্যাকারীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।

স্কুল শিক্ষিকার হত্যাকারী তার আপন ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত বলে নিশ্চিত করেছেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম। তিনি জানান, মূলত নিশাত একজন মাদকাসক্ত। একই সাথে সে আইপিএলসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। নিহতের স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান শিশির যশোরের চৌগাছা এলজিইডি অফিসে কমিউনিটি অর্গানাইজার পদে চাকরি করেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে কুষ্টিয়ায় আসতেন। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে হাউজিং ডি ব্লকে নিজের নামে ছয়তলা বিশিষ্ট ওই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন রোকসানা খানম।
পুলিশ সুপার খাইরুল আলম আরো জানান, হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের সবগুলো ইউনিটের প্রধানদের সমন্বয়ে পুলিশের একাধিক টিমকে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের জন্য মাঠে নামানো হয়। সোমবার দুপুর ২টার দিকে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই শিক্ষিকার আপন ভাতিজা নিশাতসহ ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা আরও দুই যুবককে আটক করে নিয়ে আসে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে টানা প্রায় ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত ফুফু রোকসানা খানম রুনাকে হত্যার কথা স্বীকার করে। ঘাতক নওরোজ কবির নিশাত স্কুলশিক্ষিকা রুনার আপন বড় ভাই মৃত একে এম নূরে আসলামের ছোট ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে নিশাত ছোট। মা কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লারিক্যাল পোস্টে চাকরি করেন। বড় ভাই নির্ঝর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র।
কুষ্টিয়া সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ইনচার্জ আনিসুল ইসলাম জানান, নিজের কোনও সন্তান না থাকায় ছোট বেলা থেকেই পরম আদর-স্নেহ দিয়ে কোলে পিঠে করে দুই ভাতিজা নিশাত এবং নির্ঝরকে বড় করেন ফুফু রোকসানা খানম। তবে ছোট হওয়ায় ভাতিজা নির্ঝরের চেয়ে নিশাতকেই বেশি আদর-স্নেহ করতেন। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কারণে তার দুই ছেলে এবং ভাবীকে সব সময় আগলে রাখতেন তিনি। নিজ বাড়ির ৪র্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকতে দিয়েছিলেন। আদরের ভাতিজা নিশাতকে কিছু দিন আগে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাইকও কিনে দেন। কিন্তু এরই মধ্যে নিশাত গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। একই সাথে আইপিএলসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে যায়। অনলাইন জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে দেনা পরিশোধের জন্য ফুফুর দেওয়া মোটরসাকেল গত মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। এছাড়াও ছয় তলা ওই বাড়ির সব ফ্ল্যাটের ভাড়াও সে আদায় করত। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে রোকসানা ঘুমানোর জন্য বিছানায় যান। নিশাত অপেক্ষা করতে থাকে ফুফু কখন ঘুমাবে। ফুফু ঘুমিয়ে পড়লে এক পর্যায়ে রাত ১টা থেকে ১টা ২০ মিনিটের মধ্যে স্টোর রুমে থাকা শীল দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ফুফু রোকসানা খানমের মাথায় পর পর দুটি আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
হত্যাকাণ্ডের মোড় অন্যদিকে প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে সে প্রতিটি ঘরের আসবাব-পত্র কাপড় চোপড়, ড্রয়ার সব কিছু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। একই সাথে রাত ১টা ৩৭ মিনিটের দিকে সে ফুফুর মোবাইল ফোন নিয়ে ফুফুর হোয়াস্ট আ্যাপ থেকে নিজেই তার হোয়াস্ট আ্যাপে ম্যাসেজ দিয়ে কথোপকোথন করে। যাতে ফুফু দু’জন ব্যক্তির কাছে পাওনা টাকা পেত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহের তীর যেন তাদের দিকে গিয়ে পড়ে। দুর্বৃত্তরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এসব আলামত সৃষ্টির জন্য ঘর দুয়ার সব এলোমেলো করে রাখে। বারান্দার দরজায় দা দিয়ে কোপ মারে। এক পর্যায়ে সে বরান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচে নেমে এসে হত্যাকাণ্ডের কাজে ব্যবহৃত শীলটি লিফট ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। হত্যাকাণ্ডের পর রাত ২ টা ৪৫ মিনিটের দিকে নিশাত ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা লিজান ও শাকিল নামের দুই যুবককে ডেকে তুলে শাকিলের ফ্ল্যাটে গিয়ে তিনজন মিলে একত্রে গাঁজা সেবন করে। গাঁজা সেবন শেষ হলে ঘরে ফিরে রাত ২ টা ৫৮ মিনিটের সময় শাকিলকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে কোনও শব্দ পেয়েছে কি না? শাকিল কোনও শব্দ শোনেনি বলে জানালে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘটনার দিন সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো বাড়ির নিচে মুদি দোকান খুলে বেঁচা-বিক্রি শুরু করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সে পার্শ্ববর্তী নিশান মোড়ে নাস্তা খেতে যায়। নাস্তা সেরে এসে সকাল ১০টার দিকে সে ফুফুর দরজা ধাক্কাতে থাকে। ফুফু দরজা না খোলায় অন্য ফ্লাটে থাকা ভাড়াটিয়াদের জানাই ফুফু দরজা খুলছে না। বিষয়টি সে মোবাইল ফোনে যশোরে থাকা ফুফুর স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান শিশিরকে জানায়। পরবর্তীতে তার মোবাইল ফোন থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন করে বিষয়টি জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে স্থানীয়দের সহযোগিতায় দরজা ভেঙে স্কুলশিক্ষিকা রোকসানা খানম রুনার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে।
কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম জানান, অত্যান্ত ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে নওরোজ কবির নিশাত একাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিশাতের দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নিশাতকে সাথে নিয়ে সোমবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে ওই বাড়ির লিফটের ঘর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত শীলটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। সে নিজেই শীলটি পুলিশকে ওই ঘর থেকে বের করে দেয়। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করার পর আটক অপর দুজনকে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সোমবার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিহত স্কুলশিক্ষিকা রোকসানার লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে তা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতে জানাজা শেষে ভেড়ামারায় নিজ গ্রামের কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই জহুরুল ইসলাম জানান, হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করায় আসামি নওরোজ কবির নিশাতকে মঙ্গলবার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
error: Content is protected !!